আইজ্যাক বাশোভিস সিঙ্গার রচিত The Key ছোটগল্পটি ইদ্দিশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেন মিরা গিন্সবার্গ। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য “চাবি” শিরোনামে ছোটগল্পটি ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করা হলো।
বিকেল তিনটে নাগাদ, বেসি পপকিন নিচে নামার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলো। বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা নানা রকম ঝামেলার সাথে যুক্ত, বিশেষ করে এমন গরমের দিনে: প্রথমে, আঁটসাঁট জামার ভেতর তার থলথলে শরীরটাকে ঢোকাতে হয়, গাবদা গোবদা পা দুটো ঠেসে দিতে হয় জুতোর ভেতর, আর আঁচড়াতে হয় চুল- যে চুল কিছুদিন আগে সে বাসায় বসেই হলুদ, কালো, লাল, ধূসর এমন সব রঙ দিয়ে সাজাতে গিয়ে সেটাকে আরো বিদঘুটে আর জংলি করে ফেলেছে। তারপর দেখতে হয় নিরাপত্তার ব্যাপারটা, যেন সে বাইরে গেলে তার প্রতিবেশীরা ঘরের তালা ভেঙে ঢুকতে না পারে, লিনেন কিংবা কাপড় বা দলিল পত্র চুরি করতে না পারে বা কেবল তাকে নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে ঘরের সব জিনিসপত্র এলোমেলো করতে বা লুকিয়ে ফেলতে না
মানুষের এমন উৎপাতের পাশাপাশি বেসি দৈত্য দানব, শয়তানের ছানাপোনা আর অশুভ শক্তির দ্বারাও প্রতিনিয়ত নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এইতো সেদিন, তার স্পষ্ট মনে আছে, চশমাটা সে রেখেছিলো নাইট টেবিলের উপর, পরে তা পাওয়া গেলো জুতোর ভেতর। সে তার চুলের রঙের বোতল রেখেছিলো ঔষধের তাকের উপর, কয়েকদিন পর সে তা আবিষ্কার করলো বালিশের নিচে। একবার সে একপট স্যুপ রেখেছিলো ফ্রিজের ভেতর, কিন্তু অশরীরী কিছু একটা সেই পট সেখান থেকে সরিয়ে ফেলে এবং ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর বেসি সেটা তার কাপড়ের ক্লজিটে খুঁজে পায়। ক্লজিটে থাকা কাপড় থেকে স্যুপের গন্ধ সরাতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো।
সে কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, কত কত কূট কৌশল তার ওপর খাটানোর চেষ্টা করে হয়েছে, কত কত মানুষের সঙ্গে তাকে নানা বিষয়ে ঝগড়া করতে হয়েছে তা কেবল ঈশ্বরই জানেন। সে তার টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে কেবল রাত বিরাতে ধান্দাবাজদের ফোনের যন্ত্রণায়, যারা কেবল ফোন করে তার থেকে গোপন কথা বের করে নিতে চায়। পুয়ের্তোরিকোর দুধওয়ালা একবার তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো, মুদি দোকানের বখাটে ছোঁড়াটা সিগারেট দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার ঘর। তাকে পাকাপাকিভাবে উচ্ছেদ করতে, বাড়িওয়ালা তার পঁয়ত্রিশ বছরের এপার্টমেন্ট থেকে তাকে বিতাড়িত করেছে, জায়গা করে দিয়েছে ইদুর আর তেলাপোকায় ভরা একটা ঘরে।
বেসি বহু আগেই বুঝতে পেরেছে যে- যারা হিংসুক, তাদের প্রতি রাগ দেখিয়ে আসলে কোন লাভ নেই। এই তালিকায় আছে তার ঘরের ধাতব দরজা, স্পেশাল লক, পুলিশ, মেয়র, এফবিআই এমনকি ওয়াশিংটনে বাস করা প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বাঁচতে হলে খেতে তো হবে! বেসির সারাদিন কেটে যায় জানলাগুলো ঠিকমতো লাগানো কি না, গ্যাসের লাইন লিক কি না, সবকিছু জায়গামতো আছে কি না, ড্রয়ারে সব বন্দি করা হলো কি না- এসব করতে করতে। টাকাপয়সা সে রাখে এনসাইক্লোপেডিয়ার মোটা একটা ভলিউম, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির পুরানো একটা সংখ্যা আর স্যাম পপকিনের পোকায় কাটা আর ঝরঝরে হিসেবের খাতার ভেতর। স্টক আর বন্ড কাগজগুলো সে রাখে বহুদিনের অব্যবহৃত ফায়ার প্লেসের ভেতর থাকা কাঠ আর ইজি চেয়ারের গদির নিচে। গহণাগুলো সযত্নে সেলাই করে রেখে দিয়েছে তোষকের ভেতর। বহুদিন আগে ব্যাংকে তার একটা সেফ ডিপোজিট বক্স ছিলো। পরে সে নিজেকে বুঝিয়েছে, ব্যাংকের গার্ডদের কাছে ওসব সেফের অতিরিক্ত চাবি থাকে।
পাঁচটার দিকে বেসি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখলো সে- বেঁটে, মোটা, ছোট কপাল, ভোঁতা নাক, প্রায় বুজে আসা কুতকুতে চোখ, অনেকটা চাইনিজদের মতো। থুতনিতে মনে হলো অল্পবিস্তর সাদা দাঁড়ির আভাস দেখা যাচ্ছে। ফুলের ছাপ দেয়া ফ্যাকাশে একটা জামা সে পড়েছে, মাথায় চাপিয়েছে খড়ের একটা জীর্ণ টুপি, পায়ে একজোড়া ধুঁকতে থাকা জুতো। বেরিয়ে যাবার আগে, আরো একবার তিনটে কামরা আর রান্নাঘরটা দেখে নিলো সে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে জামা, জুতো, এক কিনারে স্তুপ হয়ে আছে চিঠি যা কোনদিন যে খুলেও দেখেনি। তার স্বামী স্যাম পপকিন, মারা গিয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। মৃত্যুর আগে তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার পাততাড়ি গুটিয়েছে, কারণ তার পরিকল্পনা ছিলো ফ্লোরিডাতে অবসর যাপন করবার। মৃত্যুর আগে ফেলে গিয়েছে তার স্টক, বন্ড, সেভিং একাউন্টসের পাস বই, আর কিছু মর্টগেজ। বেসির কাছে এখনো ফার্ম থেকে রিপোর্টের কপি কিংবা চেক আসে, প্রতি সপ্তাহে রাজস্ব বোর্ড থেকে ট্যাক্স চেয়ে আসে চিঠি। প্রতি সপ্তাহে একটা ফিউনারেল কোম্পানি থেকে তাকে আকর্ষণীয় মূল্যে কবরের জায়গা কেনার অফার সম্বলিত চিঠি পাঠানো হয়। প্রথমদিকে বেসি চিঠি পত্রের জবাব দিতো, চেক জমা করতো, জমা খরচের হিসেব রাখতো। ধীরে ধীরে সেগুলো বাদ দিতে শুরু করলো সে, এমনকি বাদ দিয়ে দিলো খবরের কাগজ কেনা আর পত্রিকার অর্থনীতি পাতা পড়ার অভ্যাস।
বারান্দার দরজা আর চৌকাঠের মধ্যে ফারাক করতে সে কার্ডে- কেবল সেই বুঝতে পারবে এমন চিহ্ন ব্যবহার করে- তাপ্পি মেরে দিলো। তালার চাবির ফুটো সে বন্ধ করে দিলো পুটিং দিয়ে। সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবিহীন এক বিধবা সে- এর বেশি আর কি-ই বা করতে পারে? একটা সময় ছিলো যখন তার এই অতি সাবধানতা দেখে প্রতিবেশিরা হাসাহাসি করতো। বেসি এখন আর কারো সাথে কথা বলে না। চোখেও ভালো দেখতে পায় না সে আজকাল। চোখের চশমার কাচ অনেকদিন থেকেই ঘষে গিয়েছে। চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়াতে তার ব্যপক অনীহা। সব কিছুই তার জন্য দিনকে দিন বোঝা হয়ে উঠছিলো, এমনকি এলিভেটরে ওঠা নামার ব্যাপারটাও। এলিভেটরের এই দরজা খুলতে বা লাগাতে- দুক্ষেত্রেই বেশ জোর লাগে, যা বেসির পক্ষে দেয়া অসম্ভব।
বেসি তার নিজের বাড়ি থেকে দু’ব্লকের বেশি যায় না। মূল সড়ক আর রিভার ভিউ সাইড ড্রাইভের মাঝখানের জায়গাটা দিনকে দিন আরো দোকানপাট আর মানুষে ভরে যাচ্ছে। আর্চিনের যাযাবরদের বাচ্চাকাচ্চাগুলো অর্ধনগ্ন হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা কালো লোক- কোকড়ানো কালো চুল আর বড় বড় চোখ তার- স্প্যানিশে ঝগড়া করছে ছোটখাট আর বারোমাসি পোয়াতি এক নারীর সাথে। তাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি মিশে যাচ্ছে রাস্তার কুকুরের ঘেউঘেউ আর বেড়ালের মিউ মিউ এর সাথে। কোথাও একটা আগুন লেগেছে মনে হয়, ফায়ার এঞ্জিন, এম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি বিকট আয়াজ তুলে পাশ কাটালো। মূল সড়কে আগে একটা মুদি দোকান ছিলো, সেটা ভেঙে সুপারমার্কেট তৈরি হয়েছে। ভেতরে বাজার করতে হয় ট্রলি দিয়ে, দাম দেয়ার জন্য দাড়াতে হয় লাইনে।
স্যাম- ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিক- নিউইয়র্ক, আমেরিকা, আসলে সারা পৃথিবীটাই ভেঙে পড়ছিলো। সমস্ত ভালো প্রতিবেশীরা চলে যাচ্ছিলো ফ্ল্যাট ছেড়ে, তার বদলে জায়গা করে নিচ্ছিলো চোর, ডাকাত আর বেশ্যারা। বেসির পকেটবই চুরি হয়েছে তিনবার। পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেলে তারা হেসেই বাঁচে না। রাস্তা দিয়ে গাড়ি বেড়িয়ে যাচ্ছে হুশহাশ করে, হাতে জান নিয়ে রাস্তা পেরুতে হয়। বেসি এক পা এগুলো রাস্তা ধরে, আবার থেমে গেলো। কেউ একজন উপদেশ দিলো লাঠি নিয়ে চলতে, কিন্তু সে নিজেকে কোনভাবেই বৃদ্ধা বা খোঁড়া মনে করে না। প্রতি সপ্তাহেই সে নখে নেইল পলিশ দেয়- লাল। বাতের ব্যথাটা কোনদিন কম মনে হলে ক্লজেট থেকে সে কাপড় বের করে, গায়ে দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজেকে আয়নায়।
সুপারমার্কেটের দরজা খোলা একটা অসম্ভব কাজ। কেউ এসে দরজা খুলে ঢুকবে তার অপেক্ষা করে সে। সুপারমার্কেট আসলে শয়তানের আড্ডাখানা ছাড়া কিছুই না। পুরো স্টোরটা প্রচন্ড আলোয় উজ্জ্বল, চোখ ধাধিয়ে যায়। মানুষজন এমনভাবে ট্রলি নিয়ে ছোটাছুটি করে যেন আরেকজনকে চাপা দিয়ে দেবে। শেলফগুলো হয় খুব উঁচুতে, নাহয় একদম নিচুতে। মানুষের কোলাহলে কান পাতা দায়। বাইরে চৈত্রের গরম, আর ভেতরে মাঘের তীব্র শীত। বেসির যে নিউমোনিয়া বেঁধে যায়নি, এই ঢের। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিলো সিদ্ধান্তহীনতা- কোনটা রেখে কোনটা নেবে। প্রতিটা আইটেম সে তুলে দেখে, লেবেল পড়ে, তারপর রেখে দেয়। বাজার করতে তার বেশিক্ষণ সময় লাগার কথা না, তাও কোথা দিয়ে যেন পাক্কা দুঘন্টা বেড়িয়ে গেলো। অবশেষে ট্রলি ঠেলে যখন ক্যাশের কাছে এলো সে, মনে পড়লো ওটমিল নেয়া হনি। সে বেড়িয়ে যেতেই এক মহিলা লাইনে তার জায়গাটা দখল করে ফেললো। বিল দেয়ার পর বাধলো আরেক বিপত্তি। তার ব্যাগের ডান পকেটে বিলের কাগজটা রাখা ছিলো, সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরে সেটা পাওয়া গেলো খুচরো পয়সা রাখার পকেটে। এই কথা কে বিশ্বাস করবে? কাউকে বললে পাগল ঠাওরাবে।
বেসি যখন বাজার করতে আসে, বাইরে তখনো আলো ছিলো। বেরিয়ে সে দেখলো অন্ধকার নেমে আসছে। হাডসনের জলে সোনালী আর হলুদ রঙ ছড়িয়ে দিয়ে ডুবে যাচ্ছিলো সূর্যটা, নিউ জার্সির পাহাড়ের পেছনে। মূল সড়কের পাশের বাড়িগুলোর দেয়াল বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো উষ্ণতা- সারাদিন রোদের তাপে যা জড়ো হয়েছিলো প্লাস্টারের গভীরে। আগে কখনো মূল সড়কটাকে তার কাছে এত বেশি নোংরা আর জঘন্য মনে হয়নি। এখানে সেখানে পড়ে থাকা পচা ফল, কুকুর বেড়ালের বিষ্ঠা, পেট্রোলের আর গরমে তেতে ওঠা রাস্তার পিচের দূর্গন্ধ এসে ঝাপটা দিচ্ছিলো নাকে। ফুটপাথ দখল করে থাকা পুরানো আর ছেড়া খবরের কাগজ, সিগারেটের অবশিষ্টের উপর দিয়ে হেটে বেড়াচ্ছিলো পায়রার ঝাক। পায়রাগুলো হুট করে চলে আসা কোন পথচারীর পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে অক্কা পাচ্ছে না কি করে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। জ্বলন্ত আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছিলো সোনালী ধুলো। কৃত্রিম ঘাস ঝোলানো এক দোকানের সামনে, ঘেমে নেয়া ওঠা দুটো লোক একে অপরের গায়ে আনারস আর পেপের জুস ঢেলে দিলো, যেন গায়ের আগুন নেভাতে চাইছে তারা। রাস্তার পাশে কয়েকটা শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চা জলের পাইপ খুলে দিয়ে নর্দমায় দাপাদাপি করছিলো। এই ব্যপক হট্টগোলের মাঝে- এক নির্বাচনী প্রচারণার ট্রাক তীব্র শব্দে গান বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো- একেবারে নরক গুলজার যাকে বলে।
রাস্তা পার হওয়া, লিফটের জন্য অপেক্ষা করা, দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগেই ৫ তলায় নেমে পড়া- সবকিছু বেসিকে হাঁপিয়ে তুললো। দরজার মুখে বাজারের ব্যগটা রেখে সে চাবি খুঁজতে শুরু করলো। নখ দিয়ে খুঁটিয়ে তুললো চাবির ফুটো বন্ধ করা পুডিংটুকু, এবার চাবি ঘুরিয়ে দিলো মোচড়। খুট করে একটা আওয়াজ করে চাবি গেলো ভেঙে, কেবল চাবির পেছনের মোটা অংশটুকু রয়ে গেলো হাতে। বেসির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। অন্য সকল প্রতিবেশীরাই চাবির একটা কপি রেখেছে এপার্টমেন্টের সুপারিনডেন্টের কাছে, কিন্তু বেসি কাউকেই বিশ্বাস করে না। তাই কিছুদিন আগেই সে নতুন একটা কম্বিনেশন লক অর্ডার করেছিলো, যা- অন্তত বেসি নিশ্চিত- কোন মাস্টার কী দিয়ে খোলা সম্ভব না। একটা ডুপ্লিকেট চাবি তার আছে, কিন্তু সেটাও রাখা ড্রয়ারে, সে কেবল এই চাবিটা নিয়েই বেড়িয়েছিলো। “ভালো, আমি শেষ!”, বেসি জোরে বলে ওঠে।
সাহায্য করার মতো আশেপাশে কেউ ছিলো না। প্রতিবেশীরা তো রক্তের শত্রু। সুপার কেবল অপেক্ষা করছে কবে সে মরবে। বেসির গলায় মনে হলো কিছু একটা আটকে গিয়েছে। সে চেষ্টা করেও কাঁদতে পারলো না। সে চারদিকে তাকালো, দেখার চেষ্টা করলো কোন দানো তার এমন সর্বনাশ করলো। বেসি অনেকদিন যাবত মৃত্যুদূতের কথা ভাবছিলো, কিন্তু সে যে এত দ্রুত দরজার কাছে, এই সিড়িতে চলে আসবে তা সে ভাবেনি। এই মৃত্যুযন্ত্রণা কতক্ষণ চলবে কে জানে? সে চিন্তা করতে শুরু করলো, এমন কোন দোকান কি এখন খোলা পাওয়া যাবে যারা চাবি ঠিক করে। যদি থাকেও চাবিওয়ালা নকল চাবি তৈরি করবে কোথা থেকে? তাকে সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে এখানে আসতে হবে। সাথে আসতে হবে এই স্পেশাল লক তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের কাউকে। হাতে বেশি টাকাও নেই, যতটা দরকার অতটা নিয়েই সে বের হয়। দোকানের ক্যাশিয়ারের ফেরত দেয়া মাত্র ২০ সেন্ট সাথে আছে। “মা, আর বাঁচতে চাই না”, ইদ্দিশে বলল বেসি। বলেই অবাক হয়ে গেল, ভাষাটার কিছুটা তার মনে আছে।
বহু চিন্তাভাবনার পর বেসি নিচে নামার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল। সম্ভবত কোন হার্ডওয়ারের দোকান বা স্পেশাল লক তৈরি করে এমন দোকান এখনো খোলা আছে। তার মনে পড়ল কাছেই এমন একটা দোকান সে আগে দেখেছে। অন্যদেরও চাবি ভাঙ্গে। কিন্তু বাজারের ব্যাগে থাকা খাবারগুলো? এই বোঝা আবার বওয়া সম্ভব না। উপায়ান্তর না দেখে সেগুলো দরজার সামনেই ফেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। “যে কোন ভাবে তা চুরি হবেই”, বেসি নিজে নিজেই বলল। কে জানে হয়তো তার প্রতিবেশীরাই তালাটা কোনরকমে হেরফের করে রেখেছিল যেন সে ঘরে ঢুকতে না পারে আর সে সুযোগে তারা লুটে নিতে পারে সবকিছু।
বের হওয়ার আগে একবার দরজায় কান পাতলো বেসি।
কিছুই শুনতে পেল না সে, কেবল একটা মৃদুগঞ্জন ছাড়া। কোথা থেকে হচ্ছে তা বেসি বুঝতে পারলো না। শব্দটা কখনো মনে হচ্ছে কখনো গোঙানোর মতো, কখনো মৃদু গর্জনের মত। মনে হচ্ছে কোন দানব আটকে পড়েছে দেয়ালের ভিতর বা পানির পাইপের মধ্যে। মনে মনে খাবার গুলোকে বেসি বিদায় জানালো, যাদের অতক্ষনে ফ্রিজে ঢুকে যাওয়ার কথা। এই গরমে দরজার সামনে পড়ে থাকার কথা না। মাখনটা গলে যাবে, দুধ যাবে নষ্ট হয়ে। “এটা শাস্তি, আমি অভিশপ্ত, অভিশপ্ত!”, বেসি বিড়বিড় করে। একজন প্রতিবেশী লিফটে নামতে যাচ্ছিলেন, বেসি তাকে হাত দেখিয়ে থামালো। কে জানে সেও হয়তো চোরদের কেউ হবে। সে বেসিকে আটকে রাখতে পারে, আক্রমণ করতে পারে। লিফট নিচে নেমে এলো। লোকটা তার জন্য দরজা ধরে রাখলো। তাকে ধন্যবাদ দিতে চাইলো বেসি, কিন্তু চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে হলো তার। শত্রুকে কিসের ধন্যবাদ? এগুলো কোন না কোন ছলচাতুরি।
বেসি যখন রাস্তায় নামল ততক্ষণে রাত নেমে গিয়েছে। নর্দমা গুলো জলে ফুলে উঠেছে। রাস্তার বাতিগুলো প্রতিফলিত হচ্ছিল কালো লেকের জলে। আবারও কোথাও আগুন লেগেছে। সে শুনতে পেল সাইরেন, ফায়ার ইঞ্জিনের ঝনঝন শব্দ। তার জুতোগুলো ছিল ভেজা। সে মূল সড়কে গেলে গরমের একটা হালকা যেন ছুঁয়ে গেলো তাকে। সে দিনের বেলাতেই কম দেখে, রাতে সে যেন অন্ধই হয়ে গিয়েছে। দোকানে আলো ছিলো, কিন্তু দোকানটা কিসের তা বেসি ঠাওর করতে পারলো না। পথচারীদের সাথে ধাক্কা লাগছিলো তার, আর সে হাহুতাশ করছিল কেন সে লাঠি ব্যবহার করে না। তাও সে হাঁটতে শুরু করল দেয়াল ধরে। সে একটা ওষুধের দোকান পার করলো, পার করলো একটা কম্বল-কার্পেটের দোকান, একটা কাফনের কাপড়ের দোকান। কোথাও একটা হার্ডওয়ারের দোকান নজরে এলো না তার। বেসি হাঁটতে থাকে, তার শরীরটা ভেঙে আসছে, কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছা তার ছিল না। চাবি ভেঙ্গে গেলে মানুষের কি করা উচিত- মরে যাওয়া? সম্ভবত পুলিশে ইনফর্ম করা। এমন কোন প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই আছে যারা এমন কেসগুলো সামলায়। কিন্তু কোথায়?
কোথাও মনে হয় এক্সিডেন্ট হয়েছে। দর্শকের ভিড়, পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স রাস্তা আটকে রেখেছে। কেউ সম্ভবত রাস্তা থেকে রক্ত পরিষ্কার করতে পানি ছিটিয়েছে। দর্শকের চোখে অদ্ভুত এক সন্তুষ্টির আলো জ্বলছে যেন। “এরা মানুষের দুর্ভাগ্যকে উপভোগ করে”, সে ভাবলো। এই পোড়া শহরে এতোটুকুই তাদের আনন্দ। না, সে তাকে সাহায্য করার মত কাউকেই খুঁজে পাবে না।
সে একটা চার্চে এলো। কয়েক পা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দীর্ঘ আর কালো ছায়া দরজাটাকে ঢেকে রেখেছে। বেসি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, তার হাঁটু কাঁপছিল। জুতো যেন হুল ফোটাচ্ছিল পায়ে। “ভালো, শয়তানের সব আক্রোশ আজ রাতে আমার ওপর পড়বে।” ক্ষুধা, বমি বমি ভাব সব একসাথে তাকে যন্ত্রণা দিতে লাগল, পেটের ভিতর থেকে কিছু একটা যেন পাঁক দিয়ে এলো গলার কাছে। “ঈশ্বর, আমার সব শেষ।” তার মনে পড়ল ইদ্দিশ ভাষার সেই প্রবাদটা, “হিসেব ছাড়া বাঁচলে, বেহিসেবে প্রাণ খোয়াতে হবে”। সে নিজের উইলটাও এতদিন লেখেনি।
বেসি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। যখন সে চোখ খুললো, রাত ততক্ষণে আরো গভীর হয়ে উঠেছে। রাস্তার লোক চলাচল গিয়েছে কমে, দোকানের জানলাগুলোতে আর আলো জ্বলছিল না। গরম ততক্ষণে কিছুটা কমে গিয়েছে, জামার নিচে তার শীত করতে শুরু করলো। এক মুহূর্তে তার মনে হলো তার পকেট বুক বুঝি আবারও চুরি গিয়েছে, কিন্তু সেটা তার সামনেই পড়ে থাকতে দেখল সে, মনে হয় কোনভাবে পড়ে গিয়েছিলো। সেটা বেশি হাত বাড়িয়ে সে তুলতে চাইলো, কিন্তু তার হাতগুলো মনে হচ্ছিল অসার। দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা মাথাটা পাথরের মত ভারী মনে হচ্ছিলো তার, পাগুলো মনে হচ্ছিল কাঠের। কানের ভেতর মনে হচ্ছিলো পানি ঢুকে গিয়েছে। সে চোখ তুলে চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদটা ঝুলে ছিলো সামনেই এক বাড়ির ছাদে, পাশেই জ্বলছিলো সবুজাভ একটা তারা। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল আকাশ বলে কিছু আছে, চাঁদ আছে, আছে তারা। বহুদিন আগেই সে তার জানলাগুলো ভারী পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে যেন বাইরে থেকে কোন গুপ্তচর তার দিকে নজর রাখতে না পারে। তাহলে আকাশ যেহেতু আছে, সেখানে সম্ভবত ঈশ্বর, ফেরেশতা, স্বর্গও আছে। তার বাবা-মায়ের আত্মারা কোথায়? স্যামই বা এখন কোথায়? সে, বেসি, সকল দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। কবর খানায় স্যামের কবরটা দেখতে যায় না বহুদিন, তার মৃত্যুবার্ষিকীতে একটা মোমও জ্বালায় না সে। এত বছর পর বেসির মনে হলো প্রার্থনা করা দরকার, ঈশ্বর নিশ্চই তাকে সাহায্য করবে। যদিও সে তার যোগ্য না। ওপরে তার বাবা-মা নিশ্চয়ই তার জন্য ঈশ্বরের সাথে একটা মধ্যস্থতা করবে। কয়েকটা হিব্রু শব্দ সে মনে করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ঠোটে ভাষা ফুটল না। হঠাৎ তার মনে পড়লো সেটা, “শোনো, হে ইসরাইল”, এটা সকল ইহুদী প্রার্থনার প্রথমেই থাকে। কিন্তু তারপর? “ঈশ্বর, আমাকে রক্ষা করো”, বেসি বলে। “আমার সকল প্রাপ্যের যোগ্য আমি।”
চারপাশ ধীরে ধীরে আরো শান্ত হয়ে ওঠে। ট্রাফিক লাইটগুলো লাল থেকে সবুজ হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু তা পাস কেটে যাবার মতো গাড়ি ছিলো না বলতে গেলে। কোথা থেকে এক নিগ্রো হাজির হলো, মদ খেয়ে চুড় হয়ে আছে সে। বেসি থেকে সামান্য দূরে এসে দাঁড়ালো, চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। তারপর হেঁটে চলে গেল। বেসি জানতো তার ব্যাগ ভর্তি সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, কিন্তু এই প্রথম সে তার সম্পত্তির জন্য বিচলিত হলো না। স্যাম যাবার আগে তার জন্য পয়সা কড়ি ভালোই রেখে গিয়েছে, সে সবই অকারণে নষ্ট হলো। বেসি সবকিছু গচ্ছিত রেখেছিল বৃদ্ধ বয়সের জন্য, যেন সে এখনো যুবতী। “আমার বয়স কত?”, বেসি নিজেকে জিজ্ঞেস করে, “এত বছরে আমি কি পেলাম? কেন কোথাও বেড়ালাম না, টাকা ওড়ালাম না, সাহায্য করলাম না অন্যকে?” তার ভেতরে কিছু একটা হেসে উঠলো। “আমি মোহগ্রস্থ ছিলাম, পুরোপুরি নিজের মধ্যে ছিলাম না। কিভাবে তা ব্যাখ্যা করি?” বেসি অবাক হলো, তার মনে হলো অনেকদিন পর তার ঘুম ভেঙেছে। ভাঙা চাবিটা তার মগজের দরজা খুলে দিয়েছে, স্যামের মৃত্যুর পর যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
চাঁদটা ছাদের অন্যপাশে চলে গিয়েছে- অস্বাভাবিক রকমের বড়, লাল। কিছুটা ঢাকা পড়েছে মেঘের কারণে। বেসি কেঁপে উঠলো, সে ভাবলো খুব সহজেই এবার নিউমোনিয়া ধরবে তাকে। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে তার মৃত্যুভয় চলে গিয়েছে। হাডসন নদী থেকে উঠে আসছে ঠান্ডা বাতাস। আকাশে নতুন করে তারা ফুটছে। একটা কালো বিড়াল রাস্তা পার হলো। কিছুক্ষণের জন্য বিড়ালটা দাঁড়ালো সাইডওয়াকের পাশে, সবুজ স্ফটিকের মতো চোখ তুলে সরাসরি দেখলো বেসিকে। তারপর ধীরে ধীরে সাবধানতা অবলম্বন করে এগিয়ে এলো কাছে। বহু বছর যাবত বেসি পশুপাখিকে ঘেন্না করে এসেছে। এগুলো রোগ বহন করে, সবকিছু করে অপবিত্র। বেসির মনে হতো সব বিড়ালের মধ্যেই দানো আছে। সে সবসময়ই বেড়াল এড়িয়ে চলেছে, বিশেষ করে কালো বিড়াল। এর মধ্যে শয়তানের ছায়া স্পষ্ট, কিন্তু এই মুহূর্তে বেসির মনে এই ঘর ছাড়া, সম্পত্তিহীন, দরজা ও চাবিহীন প্রাণীটির প্রতি- যে বেঁচে আছে কেবল ঈশ্বরের দয়ায়- মমতা জেগে উঠলো। বিড়ালটা কাছে এসে বেসির ব্যাগটা শুকলো, তারপর তার পায়ের সাথে গা ঘষতে শুরু করলো, বললো , “ম্যাও”। বিড়ালটা ক্ষুধার্ত, “ওকে যদি কিছু খাওয়ানো যেত? এমন প্রাণীকে কে ঘেন্না করে?” বেসি অবাক হয়, “মা, আমি অন্ধ ছিলাম, অন্ধ। আমি আবার সব নতুন করে শুরু করবো।” একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেল তার মাথায়, “আবার বিয়ে করবো?”
রাতটা কেটে গেল অপ্রত্যাশিত সব ঘটনায়। বেসি বাতাসে একটা সাদা প্রজাপতি ভাসতে দেখলো, কিছুক্ষণ একটা থেমে থাকা গাড়ির উপর ঝুলে রইল সেটা, পরে উড়ে গেলো। বেসি জানতো এটা কোন নবজাতকের আত্মা, আসল প্রজাপতি অন্ধকারে ওড়ে না। আরেকবার, সে জেগে উঠে দেখলো একটা আগুনের গোলা, অনেকটা সাবানের বুদবুদের মতো। এক ছাদ থেকে উড়ে অন্য ছাদে এলো সেটা, তারপর গেলো হারিয়ে। সে বুঝতে পারছিলো, এইমাত্র যা দেখলো তা কোন মৃত ব্যক্তির আত্মা, যে হয়তো কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছে।
বেসি আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গে ভোর বেলায়, সেন্ট্রাল পার্কের পাশ থেকে সূর্যটা উঠছে। বেসি এখান থেকে সেটা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু মূল সড়কের আকাশ ধীরে ধীরে গোলাপি আর লালচে হয়ে উঠছে। বামদিকের বিল্ডিং-এর জানলাগুলো আলো ভরে উঠলো, জাহাজের পোর্টলের মত দেখাচ্ছিল সেগুলো। একটা কবুতর এসে নামলো কাছে, ঝাপিয়ে পড়লো রাস্তায়, ঠোকরাতে শুরু করলো কিছু একটা- হতে পারে বাসি কোন রুটির টুকরা কিংবা মাটির ঢেলা। বেসি হতবুদ্ধি হয়ে গেলো- এই পাখি বাঁচে কি করে? রাতে ঘুমায় কোথায়? বৃষ্টি, ঠান্ডা, বরফে টিকে থাকে কিভাবে? “আমি বাড়ি যাবো”, বেসি সিদ্ধান্ত নেয়। “মানুষ নিশ্চয়ই আমাকে পথে ফেলে দেবে না।”
ওঠাটা ছিল যন্ত্রণাময়। মনে হচ্ছিল সিঁড়িতে, যেখানটায় সে বসেছে, তার সাথে শরীরটা আঠা দিয়ে লেগে গিয়েছে। তার পিঠ ব্যথা করছিল, পাগুলো কাঁপছিলো, তারপরেও সে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। সকালের আর্দ্র বাতাসে সে শ্বাস নেয়। বাতাসে ঘাস আর কফির ঘ্রাণ।
সে আর একা ছিল না। আশপাশ থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছিলো, এরা সবাই কর্মজীবী। কেউ কেউ কিনছিল পত্রিকা, কেউবা নেমে যাচ্ছিলো সিঁড়ি দিয়ে পাতাল রেলস্টেশনে। সকলের মুখ আশ্চর্য রকমের শান্ত মনে হচ্ছিলো, যেন তারাও সারারাত খুঁজেছে নিজেদের আত্মাকে। আর সকালে বেরিয়ে এসেছে পরিষ্কার হৃদয় নিয়ে। বেসি বিস্মিত হলো, এখনই কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে এরা, ঘুম থেকে উঠেছে কখন? না, সকল প্রতিবেশীরাই গ্যাংস্টার বা খুনি না। এমনকি এক যুবক বেসিকে শুভ সকাল বলল পর্যন্ত। সে হাসতে চাইলো, বুঝতে পারল যৌবনের সেই নারী সুলভ কোমলতা তার মধ্যে আর নেই।
সে তার বিল্ডিং এর কাছে পৌঁছে গেলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আইরিশ সুপার, তার জন্মের শত্রু। সে ময়লাওয়ালার সাথে কথা বলছিলো- দৈত্যাকার, বোঁচা নাক, দীর্ঘ ঠোট, তোবরানো গাল আর তীক্ষ্ণ চিবুক। হলুদ চুলগুলো দিয়ে সেটা ঢেকে রেখেছে সে। বেসির দিকে চেয়ে চমকে উঠল, “কি ব্যাপার, দাদীমা?”
বেসি কোন রকমে বোঝালো কি হয়েছে তার সাথে। চাবির ভাঙ্গা অংশটাও তাকে দেখালো, সারারাত সেটা সে চেপে ধরে রেখেছিল মুঠোর মধ্যে।
“হা ঈশ্বর!”, সুপার বলে ওঠে।
“আমার কি করা উচিত?”, বেশি জিজ্ঞেস করে।
“আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।”
“কিন্তু আমার কাছে তো পাস কি নেই।”
“সব রকমের দরজায় আমাদের খুলতে জানতে হয়। আগুন লাগলে তার দরকার পড়ে।”
সুপার কিছুক্ষণের জন্য নিজ এপার্টমেন্টে ঢুকে গেলো, বেরিয়ে এলো এক গোছা চাবি আর কিছু সরঞ্জাম নিয়ে। বেসির সাথে উপরে এলো সে, বাজারের ব্যাগটা এখনো দরজায় ঠেস দিয়ে রাখা। তবে মনে হলো কিছু একটা বের করা হয়েছে সেখান থেকে। সুপারভাইজার লক খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, জিজ্ঞেস করলো, “এই কার্ডগুলো কিসের?”
বেসি জবাব দিলো না।
“আপনি আমাকে আগে কেন বললেন না কি হয়েছে? এই বয়সে আপনি সারারাত বাইরে ছিলেন, হা ঈশ্বর!”, দরজার খুট খুট আওয়াজে প্রতিবেশী দরজা খুললো, ছোটখাটো এক মহিলা বেরিয়ে এলো, পরনে হাউস কোট আর চপ্পল, চুলগুলো কোঁকড়া। বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছিলো আপনার? যতবার দরজা খুলেছি ততবারই দেখলাম ব্যাগটা দরজায় ঠেস দিয়ে রাখা। আপনার মাখন আর দুধ আমি ফ্রিজে তুলে রেখেছি।”
বেসি চোখের পানি লুকাতে চাইলো, “ঈশ্বর”, সে বলে ওঠে, “আমি জানতাম না যে…”
সুপার বেসির চাবির বাকি অংশটুকু বের করে দিলো, আর একটু নাড়াচাড়া করে কিভাবে যেন দরজাটা খুলে ফেললো। দরজার খাঁজ থেকে কার্ডগুলো গেলো পড়ে। দরজা খোলা মাত্র একটা বদ্ধ ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো, মনে হলো যেন কত দিন এখানে কেউ বাস করে না। সুপার বললো, “পরেরবার এমন কিছু হলে আমাকে জানাবেন, আমি আছি তো এজন্যই।”
বেসি ভাবলো কিছু টাকা সুপার এর হাতে দেবে। কিন্তু সে এতটাই ক্লান্ত যে ব্যাগটাও খুলতে ইচ্ছে হলো না। প্রতিবেশী মহিলা ফ্রিজে রাখা দুধ আর মাখন এনে দিলো, বেসি সোজা চলে গেল নিজের ঘরে। লম্বা হয়ে পড়ল বিছানায়, বুকে কেমন যেন চাপ লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো বমি হবে। পা থেকে মাথা অব্দি কাঁপছিলো তার। সে শুনতে পাচ্ছিলো বাইরে সুপার আর প্রতিবেশী মহিলা কথা বলছে, কিন্তু কি বলছে তা বুঝতে পারলো না। একই ঘটনা তার সাথে ঘটেছিল আরো ৩০ বছর আগে, যখন সে শুয়েছিল অপারেশনের টেবিলে। এনেস্থেসিয়া দেবার পর সে আর নার্স এবং ডাক্তারের কথোপকথন বুঝতে পারছিল না। শীঘ্রই নীরবতা নেমে এলো। দেখা গেল স্যামকে। তখন দিনও না, রাতও না। অদ্ভুত গোধূলি তখন বাইরে। স্বপ্নে, বেসি জানে স্যাম মৃত, কিন্তু কোন এক গোপন উপায়ে সে উঠে এসেছে কবর থেকে। তাকে অনেক বেশি দুর্বল আর হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিলো, কথা বলতে পারছিলো না সে। দুজন হাত ধরে ঘুরে বেড়ালো শূন্যে, যেখানে আকাশ নেই, নেই পৃথিবী। একটা টানেল কেবল- সেখানে শুধু নাম না জানা নানা কিছুর ধ্বংসাবশেষ, কিন্তু কেমন যেন পরিচিত সব। তারা নেমে এলো এমন এক অঞ্চলে যেখানে দুটো পর্বত মিলে গিয়েছে। জায়গাটা আলো হয়ে আছে- সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের মতো। কিছুক্ষণ সেখানে তারা দাঁড়িয়ে রইলো, ইতস্তত আর কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে। মনে হচ্ছিলো এটা তাদের সেই হানিমুনের রাত, যে রাতে তারা ক্যাটসিল্কের এলেনবিলে একটা ব্রাইডাল স্যুট ভাড়া নিয়েছিলো। শুনতে পেলো সেই হোটেল মালিকের গলা- একই ভঙ্গি, একই স্বরে সে বলছে- “কেবল ঢুকে পড়ুন, আপনাদের কোন চাবি লাগবে না। আর- মাজল টোভ!” (মাজল টোভ এক ধরনের হিব্রু এক্সপ্রেশন, এর অর্থ ‘শুভকামনা’)
really a good one!❤️
Thank You so much